BN / EN

খায়বার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

ইসলামের ইতিহাসে খায়বার একটি চমকপ্রদ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মদিনা থেকে বিতাড়িত ইহুদি সম্প্রদায় আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়ে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তােলে। পরিণতিতে ঐতিহাসিক খায়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
 

খায়বার ছিল মদীনার উত্তরে আশি (৮০) কিংবা ষাট মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি বড় শহর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সেখানে একটি দূর্গ ছিল এবং চাষাবাদেরও ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে সেটি একটি জন বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। 

হুদায়বিয়াহর সন্ধির ফলে রাসূলে কারীম (ﷺ) যখন আহযাব যুদ্ধের তিনটি শক্তির মধ্যে সব চাইতে শক্তিশালী দল কুরাইশদের শত্রুতা থেকে মুসলিমগণকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে করলেন, তখন অন্য দু’টি শক্তি ইহুদী ও নাজদ গোত্রসমূহের সঙ্গেও একটি সমঝোতায় আসার চিন্তাভাবনা করতে থাকলেন। উদ্দেশ্য ছিল এ সকল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শত্রুতা ও বৈরীভাব পরিহারের মাধ্যমে মুসলিমগণের শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ নিরাপদ জীবন যাপন এবং ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে অধিক পরিমাণে আত্মনিয়োগ।

যেহেতু খায়বার ছিল বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী ও কোন্দলকারীদের আড্ডা, সৈনিক মহড়ার কেন্দ্র এবং প্ররোচনা, প্রবঞ্চনা ও যুদ্ধের দাবানল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু সেহেতু এ স্থানটি সর্বাগ্রে মুসলিমগণের মনোযোগদানের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। 

এ খায়বারবাসী খন্দক যুদ্ধে মুশরিক শক্তিগুলোকে সংগঠিত করে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে লিপ্ত হতে সাহায্য এবং উৎসাহিত করেছিল। তাছাড়া, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এরাই বনু কুরাইযাহকে সর্বতোভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অধিকন্তু, এরাই তো ইসলামী সমাজের পঞ্চম বাহিনীভুক্ত মুনাফিক্বদের সঙ্গে, আহযাব যুদ্ধের তৃতীয় শক্তি বনু গাত্বাফান এবং বেদুঈনদের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রেখে চলছিল এবং নিজেরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তাঁরা তাদের এ সমস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণের একটা চরম অস্বস্তিকর অবস্থা ও অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেছিল। এমন কি নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র তারা করেছিল। এ সমস্ত অস্বস্তিকর অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যন্যোপায় হয়ে মুসলিমগণ বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে কোন্দল সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা ও পরিচালক সালামাহ বিন আবিল হুকাইক এবং আসির বিন যারেমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। অথচ শত্রুমনোভাবাপন্ন ইহুদীদের শায়েস্তা করার ব্যাপারটি মুসলিমগণের জন্য ততোধিক প্রয়োজনীয় ছিল।

কিন্তু এ ব্যাপারে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণে মুসলিমগণ যে কারণে বিলম্ব করেছিলেন তা হচ্ছে, কুরাইশ মুশরিকগণ ইহুদীদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী যুদ্ধভিজ্ঞ ও উদ্ধত ছিল এবং শক্তি সামর্থ্যে মুসলিমগণের সমকক্ষ ছিল। কাজেই কুরাইশদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পূর্বে ইহুদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শক্তি ও সম্পদ ক্ষয় করাকে নাবী কারীম (ﷺ) সঙ্গত মনে করেন নি। কিন্তু কুরাইশদের সঙ্গে যখন একটা সমঝোতায় আসা সম্ভব হল তখনই ইহুদীদের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ তিনি লাভ করলেন এবং তাদের হিসাব গ্রহণের জন্য ময়দান পরিস্কার হয়ে গেল।

 
খায়বার পরিচিতিঃ খায়বার শব্দের অর্থ হলাে দুর্গ। সিরিয়া প্রান্তরের এক বিশাল শ্যামল ভূখণ্ডে, মদিনা থেকে অষ্টম মঞ্জিল বা দু’শ মাইল দূরে খায়বার অবস্থিত। এটা ছিল মদিনা থেকে বহিষ্কৃত বিশ্বাসঘাতক ইহুদি সম্প্রদায়ের বাসস্থান এবং শক্তির প্রাণকেন্দ্র। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, খায়বার ছিল বাগবাগিচায় পূর্ণ কৃষিপ্রধান স্থান।

খায়বার যুদ্ধের কারণঃ

১. ইহুদিদের ভুল ধারণাঃ খন্দক যুদ্ধের পর ইহুদিরা মনে করেছিল, কুরাইশরা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে এখন আর মদিনা আক্রমণ সম্ভব নয়। অপরদিকে মুসলমানরাও উহুদের যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই উভয় দলকে দুর্বল ভেবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার সুবর্ণ সুযােগ মনে করে ইহুদিরা যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
 
২. ইহুদিদের দুষ্ট মনােভাব বৃদ্ধিঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, বন কাইনুকা ও বনু নযির গােত্রের ইহুদিরা খায়বারে তাদের জ্ঞাতি ভাইদের সাথে যােগ দেয়ার পর তাদের দুষ্ট মনােভাব আরাে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা দলবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের মনস্থ করে।
 
৩. মুসলমানদের উত্যক্তকরণঃ ইহুদিরা মদিনা আক্রমণের যাবতীয় গােপন প্রস্তুতি গ্রহণ করে বার বার ছােট ছােট আক্রমণ দ্বারা মুসলমানদের উত্যক্ত করতে থাকে।
 
৪. মুসলমানদের হত্যা ও জুলুমঃ একবার ইহুদিরা পথিমধ্যে মুসলিম বণিকদের একটি কাফেলা আক্রমণ করে বহু মুসলমানকে হত্যা করে এবং তাদের ধন সম্পদ লুটে নেয়। ফলে মুসলমানদের বাধ্য হয়েই খায়বারের ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।
 
৫. অপহরণের প্রতিবাদঃ ইহুদিরা একবার অতর্কিতভাবে মদিনা সীমান্তে হামলা করে মহানবী (স)-এর ২০টি উট ও চারণভূমির রক্ষক হযরত আবু যর (রা)-এর পুত্রকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর প্রতিকারে মহানবী (স) খায়বারে অভিযান প্রেরণ করতে বাধ্য হন।
 
৬. নির্বাসিত ইহুদিদের ষড়যন্ত্রঃ ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক ইহুদি গােত্র বনু কুরাইযা ও বনু নযির মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বারে আশ্রয় নিয়ে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ কারণে তারা দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ ও অস্ত্র শক্তি বৃদ্ধি করে মদিনা আক্ৰমুণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ফলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে।
 
৭. ইহুদি নেতার উচ্চাকাঙক্ষাঃ হুয়াই ইবনে আখতাবের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইহুদি নেতা আবু রাফে সাল্লাম মদিনার নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ধ্বংস করে তার শাসন কায়েম করার স্বপ্ন লালন করতে থাকে। ফলে সে খায়বারকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী সকল গােত্রকে নিয়ে ইসলামবিরােধী একটি শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক জোট গড়ে তােলে।
 
৮. বনু গাতফান ও বনু ফারার লুটতরাজঃ খায়বারের ইহুদিরা বনু গাতফানকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে যুদ্ধে উসকে দেয়ার চেষ্টা করে। গাতফান গােত্রের বাহুবল ছিল বনু ফাযারা। এ সম্প্রদায় খায়বারে এসে যুদ্ধে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এদিকে গাতফান কবিলার লুটতরাজ পরিস্থিতি গুরুতর করে তােলে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করতে শুরু করে।
 
৯. মুনাফিকদের প্ররােচনাঃ মদিনায় বসবাসকারী মুনাফিকদের প্ররােচনা খায়বার যুদ্ধের অন্যতম কারণ। মদিনার মুনাফিকরা ইহুদিদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর নেতৃত্বে মুনাফিকরা মুসলমানদের সব গোপন সংবাদ পরিবেশন করে ইহুদিদের উত্তেজিত করে তােলে। রাসূল (স) ইহুদিদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

খায়বার যুদ্ধের ঘটনাঃ

১. রণাঙ্গনে যাত্রা ও নির্বাসিত ইহুদিঃ তাদের মিত্রদের সহযােগিতায় ৪০০০ সেনাবাহিনীর যুদ্ধপ্রস্তুতির সংবাদ গুপ্তচরের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে মহানবী (স) হিজরী সপ্তম সন মােতাবেক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে দু’শ অশ্বারােহীসহ ১৬০০ মুজাহিদ নিয়ে ইহুদিদের অবস্থান কেন্দ্র খায়বারের দিকে অগ্রসর হন।
 
২. মুসলমানদের আক্রমণঃ খায়বার ও বনু গাতফানের মধ্যে যােগাযােগের পথ বন্ধ করে অবরােধ আরােপ করা হয়। ইহুদিদের নিকট রাসূল (স)-এর আগমনের কোনাে পূর্বাভাসই ছিল না। হঠাৎ তারা মুসলিম সৈন্যদের দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে। রাসূল (স) প্রথমে তাদের সন্ধির প্রস্তাব করলে তারা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাই মহানবীর আদেশে মুসলমানরা প্রথম দিনেই কামুস দুর্গ ছাড়া ৫টি দুর্গ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে কামুস দুর্গে মুসলমানরা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলেও হযরত আলী (রা)-এর নেতৃত্বে এ দুর্গ হস্তগত হয়। অবশেষে তার হাতেই মারহাব নিহত হয়।
 
৩. বনু গাতফানের নির্লিপ্ততাঃ ইহুদিদের মিত্র বনু গাতফান গােত্র মুসলমানদের আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে ইহুদিদের সাথে মিলিত না হয়ে নির্লিপ্ত থাকে। ফলে ইহুদিরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
 
৪. ইহুদিদের আত্মসমর্পণঃ দীর্ঘদিন অবরােধের পর খায়বারের ইহুদি সম্প্রদায় মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তবে রাসূল (স) তাদেরকে পূর্বের ন্যায় সকল নাগরিক সুবিধা প্রদান করেন।

খায়বার যুদ্ধের ফলাফলঃ

১. ইহুদি ষড়যন্ত্রের অবসানঃ খায়বার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চক্রান্তকারী ইহুদিরা ভীত হয়ে পড়ে। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের জাল বােনা চিরতরে থেমে যায়।
 
২. উভয়পক্ষ হতাহতের সংখ্যাঃ খায়বার যুদ্ধে ১৯ জন মুসলিম মুজাহিদ শাহাদাতবরণ করেন। ইহুদি বীর মারহাবসহ ৯৩ জন নিহত ও ৫০ জন আহত হয় এবং ইহুদিদের প্রচুর ধন সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র মুসলমানদের হস্তগত হয়। ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর ভাষ্যানুযায়ী, ২০ হাজারের শক্তিশালী ইহুদি বাহিনী মাত্র ১৬০০ মুজাহিদের আক্রমণে পযুদস্ত হয়ে মদিনা রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে সন্ধির প্রস্তাব জানায়।
 
৩. আক্রমণাত্মক অভিযানঃ খায়বার যুদ্ধ ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম আক্রমণাত্মক অভিযান। এ যুদ্ধে বিজয় ছিল প্রথম সার্থক বিজয়। আর এ যুদ্ধের ফলস্বরূপ সর্বপ্রথম আনষ্ঠানিকভাবে অমুসলিমদের যিম্মি করা হয় এবং তথায় ইসলামের শাসন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
 
৪ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিঃ খায়বার যুদ্ধের পর মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সচ্ছলতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। শুধু খায়বার থেকেই বাৎসরিক শস্যাদির অর্ধেক মদিনায় আসত। এ ছাড়া যুদ্ধোত্তর প্রচুর গনীমত মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনেছিল।
 
৫. রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ খায়বার যুদ্ধের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। ইহুদিসহ অন্যদের ওপর মদিনা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। ফলে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ইহুদি সম্প্রদায় মুসলমানদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়।
 
৬. ফাদাক ও তায়মা দখলঃ খায়বার বিজয়ের ফলস্বরূপ উম্মুল কোরা উপত্যকার শস্য শ্যামল ফাদাক ও তায়মা অঞ্চল মুসলমানদের করতলগত হয়। ফাদাকের ভূমি মহানবী (স)-এর পরিবার পরিজনের ভরণ পােষণের জন্য নির্ধারিত হয়।
 
৭. রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়ঃ ঐতিহাসিক ইমামুদ্দিন বলেন, মহানবী (স) খায়বার অভিযানে যে যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন এবং পরবর্তীতে আত্মসমর্পিত ইহুদিদের ক্ষমাপ্রদর্শন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক সুবিধা প্রদানপূর্বক যে চুক্তি সম্পাদন করেন, তাতে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
 
৮. আসাদউল্লাহ উপাধি প্রদানঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত আলী (রা) এ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন বলে মহানবী (স) তাকে আসাদউল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাকে বিখ্যাত জুলফিকার তরবারি প্রদান করেন।
 
খায়বার বিজয় ইসলামের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাের এক শুভ সূচনা। এ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলে ইহুদি সম্প্রদায়ের দম্ভ চূর্ণ হয়। এ যুদ্ধে হযরত আলী। (রা)-এর প্রদর্শিত বীরত্ব যুগে যুগে ইসলামের মুজাহিদদের প্রেরণা যােগাবে।
 
খায়বারের যুদ্ধের ঘটনা

 

মুসা বিন উকবা বলেন- হুদায়বিয়া থেকে ফেরত এসে নাবী (ﷺ) ২০ দিন বা এর চেয়ে কম সময় মদ্বীনায় অবস্থান করলেন। অতঃপর তিনি খায়বারের উদ্দেশ্যে বের হলেন। বের হওয়ার সময় তিনি সিবা বিন উরফুযাকে মদ্বীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলেন। এ সময় আবু হুরায়রা (রাঃ) মদ্বীনায় আগমণ করে ফজরের সলাতে সিবা বিন উরফুযার সাথে সাক্ষাত করলেন। সিবা বিন উরফুযাকে তিনি প্রথম রাকআতে كهيعص তথা সূরা মারইয়াম এবং দ্বিতীয় রাকআতে ويل للمطففين তথা সূরা মুতাফফিফীন তিলাওয়াত করতে শুনলেন। তিনি সলাতেই বলতে শুরু করলেন। উমুক ব্যক্তির জন্য সর্বনাশ হোক! তার নিকট রয়েছে দু’টি দাঁড়িপাল্লা। সে যখন মানুষকে কোন কিছু মেপে দেয়, তখন ছোট পাল্লা দিয়ে মেপে দেয়। আর যখন মেপে নেয় তখন বড়টি দিয়ে নেয়। সলাত শেষে তিনি সিবা-এর সাথে সাক্ষাত করলেন। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) খায়বারে গিয়ে নাবী (ﷺ)এর সাথে মিলিত হলেন। নাবী (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের সাথে কথা বলায় তারা আবু হুরায়রা ও তাঁর সাথীদেরকে মালে গণীমতের অংশ দিতে রাজী হয়ে গেলেন। সুতরাং তিনিও গণীমতের অংশ পেলেন।

নাবী (ﷺ) খায়বারে গিয়ে ফজরের সলাত পড়লেন। সলাতের পর মুসলমানগণ আরোহন করে অগ্রসর হচ্ছিলেন। নাবী (ﷺ) এর আক্রমণের খবর যেহেতু তাদের জানা ছিল না, তাই তারা সকাল বেলা তাদের চাষাবাদের জমির দিকে বের হচ্ছিল। তারা মুসলিম বাহিনীকে দেখে বলল- আল্লাহর শপথ! এই তো মুহাম্মাদ এবং তাঁর বাহিনী এসে গেছে। এই বলে তারা নিজেদের দূর্গের মধ্যে আশ্রয় নিল। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- আল্লাহু আকবার! খায়বার বরবাদ হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন সকাল বেলা কোন সম্প্রদায়ের আঙ্গিনায় অবতরণ করি, তখন যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের সকাল বেলাটি হবে খুবই মন্দ।

অতঃপর নাবী (ﷺ) আলীকে যুদ্ধের পতাকা দিলেন। হাদীছের কিতাবসমূহে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এরপর লেখক মারহাব নামক ইহুদীর সাথে আলী (রাঃ) এর লড়াইয়ের বর্ণনা এবং আমের বিন আকওয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিমের বর্ণনা থেকে জানা যায় আলী (রাঃ) মারহাবকে হত্যা করেছেন।

অতঃপর মুসলিম বাহিনী খায়বারবাসীদেরকে ঘেরাও করলেন। অবরোধ দীর্ঘ হওয়ায় মুসলিমগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। এ সময় যখন তারা খাওয়ার জন্য গৃহপালিত গাধা যবেহ করল তখন রসূল (ﷺ) তাদেরকে গৃহপালিত গাধার মাংস খেতে নিষেধ করলেন।

পরিশেষে তাদের সাথে এই শর্তে মীমাংসার চুক্তি করলেন যে, তারা খায়বার ছেড়ে চলে যাবে এবং যুদ্ধের হাতিয়ার ব্যতীত যত ইচ্ছা সম্পদ নিয়ে যেতে পারবে। তবে স্বর্ণ ও রেŠপ্য রসূল (ﷺ) এর জন্য রেখে যেতে হবে। আর শর্ত করা হল যে, কেউ যদি কোন কিছু গোপন করে কিংবা লুকিয়ে ফেলে, তবে তার জন্য নিরাপত্তার চুক্তি কার্যকর হবেনা। অতঃপর তারা একটি মশক (কলসী) লুকিয়ে ফেলল। তাতে হুআই বিন আখতাবের সম্পদ লুকায়িত ছিল। বনী নযীর কবীলাকে উচ্ছেদ করার সময় সে তা খায়বারে নিয়ে এসেছিল। নাবী (ﷺ) হুআই বিন আখতাবের চাচাকে মশকটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল- যুদ্ধ এবং অন্যান্য খরচে তা শেষ হয়ে গেছে। নাবী (ﷺ) বললেন- দিন তো বেশী হয়নি। সম্পদ ছিল বিপুল পরিমাণ। এত দ্রুত সম্পদগুলো শেষ হয়ে গেল কিভাবে? অতঃপর নাবী (ﷺ) হুআইয়ের চাচার খোঁজ-খবর রাখার জন্য যুবাইর (রাঃ) কে নিযুক্ত করে দিলেন। যুবাইর (রাঃ) যখন তার উপর চাপ প্রয়োগ করলেন, তখন সে বলল- আমি হুআইকে এই অঞ্চলের বিরানভূমির আশেপাশে ঘুরাফেরা করতে দেখেছি। সাহাবীগণ সেখানে গিয়ে তালাশ করে তা পেয়ে গেলেন।

অতঃপর রসূল (ﷺ) যখন উপরোক্ত শর্তে তাদেরকে বহিষ্কারের ইচ্ছা করলেন, তখন তারা বলল- এই শর্তে আমাদেরকে এখানেই থাকতে দিন যে, আমরা এখানের যমীন চাষাবাদ করব এবং উৎপাদিত ফল ও ফসল থেকে আমরা অর্ধেক নিব আর আপনি বাকী অর্ধেক নিবেন।

ঐ দিকে রসূল (ﷺ) এর কাছে কাজ করার মত কোন লোক ছিলনা। তাই তিনি তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন।

ইহুদীরা খায়বারে কত দিন থাকতে পারবে? চুক্তিতে এটি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ ছিলনা; বরং বিষয়টি রসূল (ﷺ) এর ইচ্ছার উপর দেয়া হয়েছিল। যত দিন ইচ্ছা তিনি তাদেরকে সেখানে থাকতে দিবেন।

চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর তিনি তাদের কাউকেই হত্যা করেন নি। তবে চুক্তি ভঙ্গ করার অপরাধে তিনি আবুল হুকাইকের দুই পুত্রকে হত্যা করলেন। তাদের একজন ছিল হুয়াইয়ের কন্যা সাফিয়ার স্বামী।

রসূল (ﷺ) সাফিয়া বিনতে হুয়াই ইবনে আখতাবকে বন্ধী করলেন। তিনি আবুল হুকাইকের এক পুত্রের বিবাহধীন ছিলেন। নাবী (ﷺ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে বিয়ে করলেন। মুক্ত করে দেয়াটাই বিয়ের মোহরানা নির্ধারণ করলেন।

খায়বারের ভূমিকে নাবী (ﷺ) ৩৬ ভাগে বিভক্ত করলেন। প্রত্যেক ভাগকে আবার ১০০ ভাগে ভাগ করে মোট ৩৬০০ অংশে ভাগ করলেন। এখান থেকে রসূল (ﷺ) এবং মুসলমানগণ অর্ধেক অর্থাৎ ১৮০০ অংশ নিলেন। আর বাকী অংশগুলো তথা ১৮০০ অংশ সেখানকার যমীন দেখা-শুনাকারী এবং বসবাসকারী মুসলমানদের জন্য রেখে দিলেন।

ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেন- খায়বারের যমীন মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার কারণ হল সেখানকার এক অংশ জয় করা হয়েছিল যুদ্ধ করে আরেক অংশ জয় করা হয়েছিল সন্ধি ও চুক্তির মাধ্যমে। যেই অংশ লড়াইয়ের মাধ্যমে জয় করা হয়েছিল, তা মুজাহিদদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়েছিল। আর যেই অংশ চুক্তির মাধ্যমে বিজিত হয়েছিল, তা খায়বারের যমীন দেখা-শুনাকারীদের জন্য এবং মুসলমানদের স্বার্থে রেখে দেয়া হয়েছিল।

তবে সঠিক কথা হচ্ছে খায়বারের সকল অংশই যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করা হয়েছিল। এটিই সঠিক ও সন্দেহাতীত কথা।

যুদ্ধের মাধ্যমে হস্তগত ভূমির ব্যাপারে মুসলমানদের ইমাম সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে সম্পূর্ণ যমীন মুসলমানদের মাঝে ভাগ করে দিতে পারেন। ইচ্ছা করলে মুসলমানদের জন্য ওয়াক্ফ হিসাবে রেখেও দিতে পারেন। অথবা তিনি ইচ্ছা করলে সৈনিকদের মাঝে ভাগ করতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তা থেকে কিছু অংশ মুসলমানদের প্রয়োজনে রেখে দিতে পারেন। নাবী (ﷺ) এই তিনটিই করেছেন। বনী কুরয়যা ও বনী নযীরের যমীন তিনি মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। মক্কার যমীনকে তিনি ভাগ করেন নি। খায়বারের অর্ধেক ভাগ করেছেন। আর বাকী অর্ধেক রেখে দিয়েছেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধিতে যারাই অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের সকলেই খায়বারে শরীক ছিলেন। শুধু জাবের বিন আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) অনুপস্থিত ছিলেন। তারপর রসূল (ﷺ) তাঁকে অংশ দিয়েছিলেন।

এই যুদ্ধের সময় নাবী (ﷺ) এর চাচাতো ভাই জা’ফর বিন আবী তালেব এবং তাঁর সাথীগণ ও আবু মুসা আশআরী (রাঃ) স্বগোত্রীয় লোকদেরকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।

এ যুদ্ধেই একজন ইহুদী মহিলা নাবী (ﷺ) এর জন্য বিষ মিশ্রিত ছাগলের মাংস হাদীয়া (উপহার) দিল। তিনি এবং তাঁর কয়েকজন সাহাবী সেটি খেলেন। এক বর্ণনায় আছে, তিনি সেই মহিলাকে কোন শাস্তি দেন নি। অন্য বর্ণনায় আছে তিনি মহিলাটিকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বর্ণনা আছে, যারা সেই খাদ্য খেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হতে যখন বিশর বিন বারা মৃত্যু বরণ করলেন, তখন নাবী (ﷺ) সেই মহিলাকে হত্যা করেছেন।

মক্কায় যখন খায়বারের যুদ্ধের খবর পৌঁছল, তখন কুরাইশরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল এবং তারা পরস্পর বাজি ধরল। একদল বলল- মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীগণ জয়লাভ করবে। আরেক দল বলল- দু’টি বন্ধুগোত্র এবং খায়বারের ইহুদীরা জয়লাভ করবে।

অতঃপর আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) হাজ্জাজ বিন ইলাতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি খায়বার বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। হাজ্জাজের প্রচুর সম্পদ ছিল। খায়বার বিজয়ের পর তিনি রসূল (ﷺ) কে বললেন- মক্কায় আমার স্ত্রীর নিকট স্বর্ণ ও অন্যান্য সম্পদ গচ্ছিত রয়েছে। সে এবং তার পরিবারের লোকেরা যদি আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে পারে, তাহলে আমার সমস্ত সম্পদ হাত ছাড়া হবে। আমাকে অনুমতি দিন। খায়বার বিজয়ের খবর তাদের কাছে যাওয়ার পূর্বেই আমি দ্রুত মক্কায় পৌঁছে যাই এবং আমার সম্পদগুলো হস্তগত করে নেই। তবে আমি মক্কায় গিয়ে এমন কিছু বলতে চাই, যার মাধ্যমে আমি আমার জান ও মালকে হেফাজত করতে পারব। রসূল (ﷺ) তাঁকে কিছু (মিথ্যা) বলার অনুমতি দিলেন।

মক্কায় গিয়ে হাজ্জাজ বিন ইলাত (রাঃ) স্বীয় স্ত্রীকে বললেন- আমার ব্যাপারটি গোপন রাখ এবং তোমার নিকট আমার যে সমস্ত মাল রয়েছে, তা একত্রিত কর। কেননা আমি মুহাম্মাদ এবং তার সাথীদের গণীমত ক্রয় করব। কারণ তারা মদ্বীনায় পরাজিত হয়েছে। মুহাম্মাদ বন্দী হয়েছে এবং তার সাথীরা তার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ইহুদীরা শপথ করে বলছে যে, তারা মুহাম্মাদকে মক্কায় পাঠাবে, যাতে তারা তাকে হত্যা করতে পারে।

খবরটি মক্কায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। মক্কার মুসলিমগণ খবরটি শুনে ব্যথিত হলেন। অপর পক্ষে মক্কার মুশরিকরা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করল। রসূল (ﷺ) এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের কাছে খবরটি পৌঁছলে তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। খবর শুনে তিনি এতই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে, উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট রইলনা। তার গৃহের দরজায় মুসলিম ও মুশরিকদের অগণিত লোকের সমাবেশ ঘটল। তাদের কেউ আনন্দ প্রকাশ করছিল আবার কেউ দুঃখ প্রকাশ করছিল। পরক্ষণেই আববাস দৃঢ়তার সাথে একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। এতে তিনি এমন ভাব প্রকাশ করলেন যে, তাতে মনে হয় মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পরাজয় বরণ করার খবর সঠিক হতে পারেনা। কারণ আববাসের জানা ছিল যে, আল্লাহ্ তাঁর রসূলকে বিজয়ী করার ওয়াদা করেছেন। আর আল্লাহর ওয়াদা কখনও মিথ্যা হতে পারেনা। কবিতার ভাষায় আববাসের দৃঢ়তা দেখে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর অনুসারী এবং তার শুভাকাঙ্খীদের মনে সাহসের সঞ্চার হল। মুশরিকরা মনে করল, আববাসের কাছে হয়ত অন্য কোন খবর থাকতে পারে। অতঃপর আববাস খবরটির সত্যতা যাচাই করার জন্য হাজ্জাজ বিন ইলাতের কাছে স্বীয় খাদেমকে পাঠালেন। পাঠানোর সময় খাদেমকে বলে দিলেনঃ তুমি গোপনে হাজ্জাজের সাথে মিলিত হও এবং বলঃ মরণ হোক তোমার! এ কি সংবাদ শুনালে? মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সাথে আল্লাহ্ তা‘আলা যে ওয়াদা করেছেন, তা তোমার এই খবরের চেয়ে অনেক ভাল। খাদেম যখন হাজ্জাজের সাথে কথা শেষ করল তখন হাজ্জাজ বলল- তুমি গিয়ে আবুল ফজল তথা আববাসকে আমার সালাম দাও এবং এ কথা জানিয়ে দাও সে যেন, তাঁর কোন একটি ঘরে একাকী অবস্থান করে। আমি অচিরেই তার সাথে দেখা করে এমন খবর দিব, যা তাকে খুশী করবে। খাদেম ঘরের দরজায় এসে বলল- হে আবুল ফজল (আববাস)! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। এই কথা শুনে আববাস (রাঃ) খুশীতে লাফিয়ে উঠলেন। মনে হচ্ছিল, তিনি বিপদজনক কোন খবরই শুনেন নি। তিনি এগিয়ে এসে খাদেমের দু’চোখের মাঝখানে চুম্বন করলেন। অতঃপর খাদেম হাজ্জাজের কথা জনিয়ে দিল। এতে খুশী হয়ে তিনি সেই দাসকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তিনি সেই খাদেমকে বললেন- হাজ্জাজ তোমাকে যা বলেছে, এবার আমাকে তা শুনাও। খাদেম বলল- তার সাথে একামেত্ম সাক্ষাত করার জন্য একটি ঘরে একাকী প্রবেশ করুন। তিনি আজ দুপুরে আপনার কাছে আসবেন এবং কথা বলবেন।

সুতরাং হাজ্জাজ আসলেন এবং আববাসের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করলেন। হাজ্জাজ তাঁর কাছে এসে প্রথমে অঙ্গিকার নিলেন যে, অবশ্যই এই খবর মক্কাবাসী থেকে গোপন রাখতে হবে। আববাস নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গেলেন।

এবার হাজ্জাজ আসল ঘটনা খুলে বলতে লাগলেন। তিনি বলেন- আমি দেখে আসলামঃ আপনার ভাতিজা খায়বারবাসীর উপর জয়লাভ করেছে, তাদের সমস্ত সম্পদ গণীমত হিসাবে তাঁর হস্তগত হয়েছে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে মুসলিমগণ তা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। আর সেখানকার রাজার কন্যা সাফিয়া বিনতে হুআইকে নিজের স্ত্রী বানিয়ে ফেলেছেন এবং তার সাথে বাসরও করে ফেলেছেন। আর আমি এখানে এসেছি, যাতে আমার সম্পদগুলো একত্রিত করে নিয়ে যেতে পারি। আমি রসূল (ﷺ) থেকে অনুমতি নিয়েই সেচ্ছায় এ ব্যাপারে মূল সত্যটি গোপন করছি। সুতরাং আপনি তিন দিন পর্যন্ত আমার এই খবর গোপন রাখুন। তিন দিন পর আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।

যাই হোক হাজ্জাজের স্ত্রী তার সমস্ত সম্পদ একত্রিত করল। সম্পদগুলো নিয়ে হাজ্জাজ দ্রুত গতিতে মদ্বীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন। তিন দিন পার হওয়ার পর আববাস (রাঃ) হাজ্জাজের স্ত্রীর নিকট গিয়ে বললেন- তোমার স্বামীর খবর কি? সে বলল- তিনি তো মদ্বীনায় গমণ করেছেন। হে আবুল ফজল! আল্লাহ্ আপনাকে চিন্তামুক্ত রাখুন। আপনার ভাতিজার খবর শুনে আমরাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি বললেন- হ্যাঁ, ঠিক আছে। আল্লাহ্ আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবেন না। আমি যা পছন্দ করি, আল্লাহর মেহেরবানীতে তাই হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে খায়বারের বিজয় দান করেছেন। তাতে আল্লাহর ফয়সালা কার্যকর হয়েছে। সেই সাথে আমার ভাতিজা খায়বারের রাজার মেয়েকে বিয়েও করে ফেলেছেন। এখন যদি তোমার স্বামীর প্রতি তোমার দরদ থাকে, তাহলে মদ্বীনায় গিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর সাথে মিলিত হও। হাজ্জাজের স্ত্রী বলল- আমার ধারণা আপনি ঠিকই বলেছেন। আববাস বললেন- আল্লাহর শপথ! আমি সত্য বলছি। আমি যা বলছি, বাস্তবেও তাই।

এবার হাজ্জাজের স্ত্রী বলল- আপনাকে এ বিষয়ে কে খবর দিয়েছে? আববাস (রাঃ) বললেন- তোমাকে যে ব্যক্তি এ বিষয়ে খবর দিয়েছেন, আমাকেও তিনি খবর দিয়েছেন। অর্থাৎ তোমার স্বামীই আমাকে তা জানিয়েছেন। এরপর আববাস কুরাইশদের মজলিসের দিকে গেলেন। কুরাইশরা আববাসকে দেখেই বলতে লাগল- আল্লাহর শপথ! হে আবুল ফজল! আপনাকে খুশী খুশী মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে আপনার কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু হয়নি। তিনি বললেন- হ্যাঁ, আমার কোন অকল্যাণ হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ। হাজ্জাজ আমাকে এই এই খবর দিয়েছেন। অর্থাৎ খায়বারবাসীর উপর আমার ভাতিজা মুহাম্মাদের জয়লাভের খবর দিয়েছেন। বিশেষ প্রয়োজনে তিনি আমাকে এই খবরটি তিন দিন গোপন রাখতে বলেছেন। তাই তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আজ আমি তোমাদেরকে সেই সুখবরটি দিচ্ছি। মক্কাতে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে মুসলিমগণ দ্রুত বের হয়ে আববাস (রাঃ) এর কাছে গেলেন। তিনি তাদেরকে সংবাদটি শুনালেন। এই খবরের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিমদের দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দিলেন এবং তাদের চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল

Loading

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!