BN / EN

হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মক্কা শরিফ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর আল্লাহর জন্য হজ্জ আদায় করা ফরজ’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)। ইসলামের এ ফরজ বিধানটি সঠিকভাবে পালন করার জন্য কিছু বিধানাবলী রয়েছে। হজ্জ আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য এসব বিধানের প্রতি লক্ষ রাখা আবশ্যক। 

হজ্জের ফরজ তিনটি

(১) ইহরাম বাঁধা: হজ্জের নিয়ত করে হজ্জের পোশাক (সেলাইবিহীন দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পুরুষদের জন্য) পরিধান করা ও তালবিয়া (لَبَّيْكَ اللّهُمَّ لَبَّيْكْ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكْ ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكْ ، لا شَرِيْكَ لَكْ) একবার পড়া। এটাকে ইহরাম বলে।

(২) আরাফাহ ময়দানে অবস্থান করা:  ৯ জিলহজ আরাফায় অবস্থান করা (কিছু সময়ের জন্য হলেও)।

(৩) তাওয়াফে জিয়ারাত:  তাওয়াফে ইফাদা বা জিয়ারতের তাওয়াফের প্রথম চার চক্কর ফরজ, বাকি তিন চক্কর ওয়াজিব। ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্বে হজের উদ্দেশ্যে তাওয়াফ করতে হয়। ১০ জিলহজ যারা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মেরে কুরবানি করে (তামাত্তু কিংবা কিরান হজ্জপালনকারী) মাথা মুণ্ডনের মাধ্যমে হালাল হয়ে গেছেন তাদের জন্য এ তাওয়াফে রমল করা লাগবে। আর ইযতিবা (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে বাম কাঁধের ওপর ফেলা) করা লাগবে না। এ তাওয়াফের পরবর্তী সায়ী আরাফার দিনের পূর্বেই আদায় করে নেওয়ার সুযোগ আছে। তাওয়াফে কুদুমের পর অগ্রিম সায়ী করা না হলে তাওয়াফে জিয়ারতের পর সায়ী করলে রমল এবং ইযতিবা করতে হবে । তবে যারা তাওয়াফে কুদম-এ (বাইতুল্লায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে যে তাওয়াফ) রমল এবং সাফা-মারওয়ায় সাঈ করেছেন, তারা পুনরায় তাওয়াফে জিয়ারাতের সময় রমল এবং সাঈ করবে না।

এ ফরজগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্ধারিত ক্রমানুসারে আদায় করা। উল্লেখ্য, উপরি উক্ত তিনটি ফরজের কোনো একটি বাদ পড়লে হজ্জ হবে না।

বুহুতি (রহঃ) ‘আর-রওদুল মুরবি’ গ্রন্থে (১/২৮৫) বলেন, হজ্জের রুকন ৪টি: ইহরাম করা; ইহরাম হচ্ছে- হজ্জের কার্যাবলী শুরু করার নিয়ত করা। দলিল হচ্ছে- “সকল আমল নিয়্যত অনুযায়ী হয়ে থাকে।”[আল-হাদিস] আরাফাতে অবস্থান করা; দলিল হচ্ছে- “হজ্জ মানে- আরাফা”[আল-হাদিস] তাওয়াফে যিয়ারা (এটাকে তওয়াফে ইফাযাও বলা হয়) আদায় করা; দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ২৯] সায়ী করা; দলিল হচ্ছে- “তোমরা সায়ী কর, কেননা নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সায়ী করা ফরয করে দিয়েছেন”[মুসনাদে আহমাদ]

হজ্জের ওয়াজিব সমূহ

(১) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা :
ইহরাম বাঁধার কাজটি মীকাত পার হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা ।
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَقَّتَ لأَهْلِ الْمَدِينَةِ ذَا الْحُلَيْفَةِ وَلأَهْلِ الشَّأْمِ الْجُحْفَةَ وَلأَهْلِ الْيَمَنِ يَلَمْلَمَ وَلأَهْلِ نَجْدٍ قَرْنًا فَهُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ مِمَّنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ فَمَنْ كَانَ دُونَهُنَّ فَمِنْ أَهْلِهِ حَتَّى إِنَّ أَهْلَ مَكَّةَ يُهِلُّونَ مِنْهَا
ইবনু ‘আববাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাবাসীদের জন্য মীকাত নির্ধারণ করেন যুল-হুলায়ফাহ, সিরিয়াবাসীদের জন্য জুহফা, ইয়ামানবাসীদের জন্য ইয়ালামলাম ও নাজদবাসীদের জন্য ক্বারণ। উল্লিখিত স্থানসমূহ হজ্জ্ব ও ‘উমরাহ’র নিয়্যাতকারী সে স্থানের অধিবাসী এবং সে সীমারেখা দিয়ে অতিক্রমকারী অন্যান্য এলাকার অধিবাসীদের জন্য ইহরাম বাঁধার স্থান। আর যে মীকাতের ভিতরের অধিবাসী সে নিজ বাড়ি হতে ইহরাম বাঁধবে। এমনকি মক্কাবাসীগণ মক্কা হতেই ইহরাম বাঁধাবে। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং-১৫২৯)

(২) সূর্য্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করতে থাকা :
عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ: ثُمَّ أَرْدَفَ أُسَامَةَ فَجَعَلَ يُعْنِقُ عَلَى نَاقَتِهِ وَالنَّاسُ يَضْرِبُونَ الْإِبِلَ يَمِينًا، وَشِمَالًا، لَا يَلْتَفِتُ إِلَيْهِمْ وَيَقُولُ: السَّكِينَةَ أَيُّهَا النَّاسُ وَدَفَعَ حِينَ غَابَتِ الشَّمْسُ
আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, অতঃপর তিনি উসামাহকে বাহনের পেছনে বসিয়ে মধ্যম গতিতে উষ্ট্রী চালিয়ে গেলেন। এ সময় লোকেরা তাদের উটকে ডানে-বামে মারধর করে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগলেনঃ শান্ত গতিতে চলো হে লোকেরা! অতঃপর সূর্য ডুবার পরই তিনি আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। (সুনানু দাউদ, হাদিস নং-১৯২২)

(৩) অকুফে মুযদালিফা : 
আরাফার দিন শেষে ঈদের রাতটি ফজর পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা যতক্ষণ আকাশ প্রস্ফুটিত না হয়। তবে মহিলা ও দুর্বল পুরুষদের জন্য মধ্য রাতের পর মুযদালিফা ত্যাগ করা বৈধ আছে।
عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ يُقَدِّمُ ضَعَفَةَ أَهْلِهِ فَيَقِفُونَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ بِالْمُزْدَلِفَةِ بِلَيْلٍ فَيَذْكُرُونَ اللهَ مَا بَدَا لَهُمْ ثُمَّ يَرْجِعُونَ قَبْلَ أَنْ يَقِفَ الإِمَامُ وَقَبْلَ أَنْ يَدْفَعَ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقْدَمُ مِنًى لِصَلاَةِ الْفَجْرِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَقْدَمُ بَعْدَ ذَلِكَ فَإِذَا قَدِمُوا رَمَوْا الْجَمْرَةَ وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يَقُولُ أَرْخَصَ فِي أُولَئِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পরিবারের দুর্বল লোকদের আগেই পাঠিয়ে দিয়ে রাতে মুযদালিফাতে মাশ‘আরে হারামের নিকট উকূফ করতেন এবং সাধ্যমত আল্লাহর যিকর করতেন। অতঃপর ইমাম (মুযদালিফায়) উকূফ করার ও রওয়ানা হওয়ার আগেই তাঁরা (মিনায়) ফিরে যেতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ মিনাতে আগমন করতেন ফজরের সালাতের সময় আর কেউ এরপরে আসতেন, মিনাতে এসে তাঁরা কঙ্কর মারতেন। ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কড়াকড়ি শিথিল করে সহজ করে দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ১৬৭৬)

(৪) আইয়ামে তাশরিকের (অর্থাৎ ১১, ১২ ও ১৩ তারিখের) রাত্রি গুলি মীনা এলাকায় কাটানো:
মুযদালিফার পর কমপক্ষে দুই রাত্রি মিনায় যাপন করা । ১০ ও ১১ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় থাকা ওয়াজিব। ১২ই যিলহজ্জ তারিখে পাথর নিক্ষেপ শেষে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ঐ তারিখের দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়।০, ১১ ও ১২ই যিলহজ্জ তারিখে দিনের বেলায় মিনায় থাকা জরুরী না, তবে থাকাটা উত্তম। রাতের অর্ধেকের বেশী পরিমাণ সময় মিনায় কাটালে রাত্রি যাপনের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে ।
“যাদের যমযম পানি পান করানো কিংবা হাদির পশু চরানোর দায়িত্ব নেই তাদের জন্য তাশরিকের দিনগুলোতে মীনার ময়দানে রাত্রি যাপন করা।
عَنْ ابْنِ عُمَرَأَنَّ الْعَبَّاسَ اسْتَأْذَنَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم لِيَبِيتَ بِمَكَّةَ لَيَالِيَ مِنًى مِنْ أَجْلِ سِقَايَتِهِ فَأَذِنَ لَهُ
تَابَعَهُ أَبُو أُسَامَةَ وَعُقْبَةُ بْنُ خَالِدٍ وَأَبُو ضَمْرَةَ
ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, ‘আববাস(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)পানি পান করানোর জন্য মিনার রাতগুলোতে মক্কায় অবস্থানের ব্যাপারে নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৪৫,তাওহীদ পাবলিকেশন)

(৫) মিনায় তিন শয়তান (জামারাত) সমূহকে পাথর নিক্ষেপ করা :
আইয়ামে তাশরিকের দিন গুলিতে তিন জামারাতেই কংকর তথা পাথর নিক্ষেপ করা। ক্রমধারা রক্ষা করে জমরাতগুলোতে কংকর নিক্ষেপ করা।
عَنْ ابْنِ عُمَرَأَنَّهُ كَانَ يَرْمِي الْجَمْرَةَ الدُّنْيَا بِسَبْعِ حَصَيَاتٍ يُكَبِّرُ عَلَى إِثْرِ كُلِّ حَصَاةٍ ثُمَّ يَتَقَدَّمُ حَتَّى يُسْهِلَ فَيَقُومَ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ فَيَقُومُ طَوِيلاً وَيَدْعُو وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ ثُمَّ يَرْمِي الْوُسْطَى ثُمَّ يَأْخُذُ ذَاتَ الشِّمَالِ فَيَسْتَهِلُ وَيَقُومُ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ فَيَقُومُ طَوِيلاً وَيَدْعُو وَيَرْفَعُ يَدَيْهِ وَيَقُومُ طَوِيلاً ثُمَّ يَرْمِي جَمْرَةَ ذَاتِ الْعَقَبَةِ مِنْ بَطْنِ الْوَادِي وَلاَ يَقِفُ عِنْدَهَا ثُمَّ يَنْصَرِفُ فَيَقُولُ هَكَذَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَفْعَلُهُ
ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত যে, তিনি প্রথম জামরায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন এবং প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলতেন। তারপর সামনে অগ্রসর হয়ে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতেন এবং উভয় হাত তুলে দু‘আ করতেন। অতঃপর মধ্যবর্তী জামরায় কঙ্কর মারতেন এবং একটু বাঁ দিকে চলে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী দাঁড়িয়ে উভয় হাত উঠিয়ে দু‘আ করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। এরপর বাতনে ওয়াদী হতে জামরায়ে ‘আকাবায় কঙ্কর মারতেন। এর কাছে তিনি বিলম্ব না করে ফিরে আসতেন এবং বলতেন, আমি নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এরূপ করতে দেখেছি। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৫১,তাওহীদ পাবলিকেশন)

(৬) ‘হজ্জে তামাত্তু’ ও ‘কিরান’ কারীগণ কুরবানী করা:
তামাত্তু কিংবা কিরান হজ্জপালনকারী হলে তার উপর হাদি (ছাগল জবাই করা) ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলার বাণী: “তোমাদের মধ্যে যে কেউ উমরাকে হজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে লাভবান হতে চায় সে সহজলভ্য হাদি জবাই করবে। কিন্তু যদি কেউ তা না পায়, তবে তাকে হজ্জের সময় তিনদিন এবং ঘরে ফেরার পর সাতদিন এ পূর্ণ দশদিন রোযা পালন করতে হবে। এটা তাদের জন্য, যাদের পরিজনবর্গ মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬] 
عَبْدَ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ كَانَ يَنْحَرُ فِي الْمَنْحَرِ قَالَ عُبَيْدُ اللهِ مَنْحَرِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم
আবদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কুরবানীর স্থানে কুরবানী করতেন। ‘উবাইদুল্লাহ (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) বলেন, (অর্থাৎ) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানীর স্থানে। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং-১৭১০)

(৭) এহরাম খোলার পূর্বে মাথার চুল মুন্ডানো বা ছাটা:
(দশ তারিখ ঈদের দিনে জামারাতুল আকাবাতে বা সর্ব শেষ বড় পাথর মারার স্থানে পাথর নিক্ষেপ করে) মাথার চুল মুন্ডন করা অথবা ছোট করা।
عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ قَالَ حَلَقَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَطَائِفَةٌ مِنْ أَصْحَابِهِ وَقَصَّرَ بَعْضُهُمْ
আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা কামালেন এবং সহাবীদের একদলও। আর অন্য একটি দল চুল ছোট করলেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭২৯)

(৮) ১০ই জিলহজ্জ বড় শয়তানকে ৭টি পাথর মারা, এরপর কোরবানি করা (হজ্জে তামাত্তু’ ও কিরান এর জন্য), এরপর চুল মুন্ডান করে এহরাম খোলা, এরপর তাওয়াফে জিয়ারাত করা, এই কাজগুলো ক্রমানুসারে পর পর  আদায় করা । হানাফী মাযহাবে ১০ যিলহজ্জ তারিখে হজ্জের চারটি কার্যক্রমে তারতীব বা ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা ওয়াজিব। অন্যান্য উলামাদের মতে ভুলক্রমে তারতীব ছুটে গেলে হজ্জ শুদ্ধ হয়ে যাবে । হাদীর টাকা যারা ব্যাংকে জমা দেয় কোন কারণে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে তাদের চুল কাটার পর যদি পশু যবাই হয় তাহলে ওযর থাকায় কোন অসুবিধা নেই, তবে অপেক্ষা করে নিশ্চিত হবার পর চুল মুন্ডান করার চেষ্টা করা ।

(৯) হজ্জের সায়ী:
‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দ্বয়ের মাঝে ৭ বার সায়ী করা । সাধারনত হজ্জের ফরজ তাওয়াফে জিয়ারাতের পরই হজ্জের সায়ী করা হয় ।

(১০) মক্কা থেকে বিদায়কালীন তাওয়াফ করা:
হজ্জ শেষে মক্কা শরীফ থেকে যখন বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নেবেন তখন বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। বিদায়ী তাওয়াফের পর মক্কায় আর অবস্থান করবেন না। এ তাওয়াফে রমল, ইযতিবা ও সাঈ নেই।। এ তাওয়াফ হল হজ্জের সর্বশেষ কাজ। হানাফী মাযহাবে বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব। এটা ছুটে গেলে দম দিতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

لاَ يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْتِ

‘‘কাবাঘরে বিদায়ী তাওয়াফ’’ করা ছাড়া যেন কেউ দেশে ফিরে না যায়।’’ (মুসলিম ১৩২৭)
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ أُمِرَ النَّاسُ أَنْ يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِمْ بِالْبَيْتِ إِلاَّ أَنَّهُ خُفِّفَ عَنْ الْحَائِضِ
ইবনু আববাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেদের আদেশ দেয়া হয় যে, তাদের শেষ কাজ যেন হয় বাইতুল্লাহর তাওয়াফ। তবে এ হুকুম ঋতুমতী মহিলাদের জন্য শিথিল করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-১৭৫৫)
হানাফী মাযহাবে এটা হজ্জের অন্তর্ভুক্ত এবং এটা ওয়াজিব। কোন কোন মাযহাবে এটাকে হজ্জের বহির্ভূত পৃথক ইবাদত হিসেবে পালন করা হয়। তাদের মতে মক্কাবাসী বা মক্কায় অবস্থানরত ভিন দেশী এবং বহিরাগত লোকেরা মক্কা থেকে সফরে বের হলে বিদায়ী তাওয়াফ করা লাগবে এবং এটা বছরের যে কোন সময়েই হোক না কেন। এ তাওয়াফটি শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা মীকাতের বাইরে থেকে আসবেন এবং আবার নিজ দেশে চলে যাবেন। বিদায়ী তাওয়াফের পর সাঈ করা লাগে না।

হজ্জের সুন্নতসমূহ

(১) ইহরামের পূর্বে গোসল করা

(২) পুরুষদের সাদা রঙের ইহরামের কাপড় পরিধান করা।

(৩) তালবিয়াহ পাঠ করা

(৪) তাওয়াফে কুদুম : এফরাদ হজ্জকারী মক্কায় এসে প্রথম যে তাওয়াফ আদায় করে তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। কেরান হজ্জকারী ও তামাত্তু হজ্জকারী উমরার উদ্দেশ্যে যে তাওয়াফ করে থাকেন তা তাওয়াফে কুদুমেরও স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। তবে হানাফি মাজহাব অনুযায়ী কেরান হজ্জকারীকে উমরার তাওয়াফের পর ভিন্নভাবে তাওয়াফে কুদুম আদায় করতে হয়। হানাফি মাজহাবে তামাত্তু ও শুধু উমরা পালনকারীর জন্য কোনো তাওয়াফে কুদুম নেই। ইফরাদ হজ্বকারী সর্বপ্রথম যখন বাইতুল্লাহর সামনে যাবেন তখন এই তাওয়াফ আদায় করবেন। আর কিরান হজ্বকারী উমরার কাজ শেষ করার পর হজ্বের কাজ শুরু করার সময় এই তাওয়াফ করবেন। কুদুম শব্দের অর্থ আগমণ। সে হিসেবে তাওয়াফে কুদুম কেবল বহিরাগত হাজিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীরা যেহেতু অন্য কোথাও থেকে আগমন করে না, তাই তাদের জন্য তাওয়াফে কুদুম সুন্নত নয়।

(৫) ইযতিবা ও রমল করা : তাওয়াফে কুদুমের পর যদি হজ্জের সায়ী করার ইচ্ছা থাকে, তবে তাতে রমল ও ইযতিবা করা (আর তাওয়াফে কুদুমের পরে হজ্জের সায়ী করার ইচ্ছা না থাকলে তাতে রমল ও ইযতিবা করতে হবে না।

(৬)  সাফা মারওয়ায় সায়ীর সময় সবুজ দুপিলারের মধ্যবর্তী স্থান পুরুষের জন্য দৌঁড়ে অতিক্রম করা এবং অবশিষ্ট স্থান হেঁটে চলা। সাফা-মারমওয়া পাহাড়ে আরোহন করা ।

(৭) হাজারে আসওয়াদকে চুমু খাওয়া ।

(৮) ৮ জিলহজ বাদ ফজর মিনার উদ্দেশ্যে রওয়া হওয়া এবং তথায় পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (যোহর, আছর, মাগরিব, এশা ও ৯ তারিখ ফজর) আদায় করা। (ভিড় এড়াবার লক্ষ্যে বা অন্য কোনো কারণে ফজরের পূর্বে ও রাতে রওনা দেয়াও জায়েজ।)

(৯) আরাফার রাত্রিতে মীনাতে রাত্রিযাপন করা : ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা হতে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া । (কোনো অসুবিধার কারণে বা  ভিড় এড়াবার লক্ষ্যে বা অন্য কোনো কারণে ফজরের পূর্বে ও রাতে রওনা হওয়াও জায়েজ।)

(১০) আরাফা থেকে সূর্যাস্তের পর ধীরস্থীরভাবে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া । 

(১১) ৯ যিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর আরাফা থেকে মুযদালিফায় এসে রাতযাপন করা। (উল্লেখ্য, মুযদালিফায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই কিছুক্ষণ উকুফ বা অবস্থান করা ওয়াজিব, সুবহে সাদিকের পূর্বে অবস্থান করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।)

(১২) আরাফার ময়দানে গোসল করা।(তবে পানির পরিমাণ বুঝে গোসল করা উচিত। সামান্য পানি দিয়ে গোসল করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। কেউ কেউ আরাফায় পৌছে প্রচুর পানি অপচয় করে গোসল করে ও কাপড় ধুয়ে পানি শেষ করে ফেলে। ফলে কোনো কোনো ক্যাম্পে অযু, এস্তেঞ্জা ও খাবার পানি নিয়ে সকলকে সংকটে পড়তে হয়।)

(১৩) ৮ যিলহজ দিনগত রাতসহ মিনায় অবস্থানের দিনগুলোতে রাতযাপনও মিনাতে করা।

(১৪) ছোট ও মধ্যম জামারায় কংকর নিক্ষেপের পর দু‘আ করা। 

উক্ত সুন্নতসমূহ থেকে কোনো সুন্নত স্বেচ্চায় ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। অবশ্য ছেড়ে দেয়ার দ্বারা সদকা ইত্যাদিও ওয়াজিব হবে না, তবে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন আমলের মাঝে আরো অনেক সুন্নত রয়েছে।

কী কারণে হজ্জ ভঙ্গ হয়ে যায়?

(ক) হজ্জের কোন রুকন ছুটে গেলে।
(খ) স্ত্রী সহবাস করলে।

হাজীরা কি হজ্জ পালন অবস্থায় ঈদের নামায পড়বে?

না, পড়বে না।

ইহরামের সময় হায়েয-নেফাসওয়ালী মেয়েরা কি করবে?
তারা পরিচ্ছন্ন হবে, গোসল করবে, ইহরাম পরবে। কিন্তু হায়েয-নেফাস অবস্থায় নামায পড়বে না এবং কাবাঘর তাওয়াফ করবে না। বাকী অন্যসব কাজ করবে। এরপর যখন পবিত্র হবে তখন অজু-গোসল করে তাওয়াফ ও সাঈ করবে। যদি ইহরামের পর হায়েয শুরু হয় তখনো কাবা তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ পবিত্র না হয়।

যদি তাওয়াফ শেষ করার পর সাঈ শুরু করার পূর্বে কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়ে যায় তাহলে কী করবে?

সাঈ করে ফেলবে। কারণ সাঈতে পবিত্রতা অর্জন শর্ত নয়, বরং মুস্তাহাব।

সুগন্ধিযুক্ত সাবান দিয়ে ইহরাম অবস্থায় হাত বা শরীর ধৌত করতে পারবে কি?

না, সুগন্ধওয়ালা সাবান দিয়ে গোসল করা জায়েয নয়, এমনকি হাতও ধুইবে না।

তাওয়াফুল কুদুম বা উমরার তাওয়াফ ছাড়া বাকী সব তাওয়াফ কী পোষাকে করব?

স্বাভাবিক পোষাক পরিধান করেই করবেন।

Loading

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: Content is protected !!